গতকাল ২৫ অক্টোবর, ২০১৯(২৫৬৩ বুদ্ধাব্দ), রোজ শুক্রবার, ঢাকার মিরপুরস্থ শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ ও শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা কমিটির আয়োজনে ৩১তম কঠিন চীবর দানোৎসব দিনব্যাপী মহাসমারোহে ধর্মীয় আবহে উদযাপন করা হয়। যদিও দু’দিন যাবত ঢাকার বৈরী আবহাওয়া ছিল; প্রতিকূল পরিবেশ উপেক্ষা করে শত পুণ্যার্থী পুণ্য লাভের প্রত্যাশায় স্ব:তস্ফূর্টভাবে মহতি পুণ্যানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে থাকেন।

এই ঐতিহাসিক দানানুষ্ঠানে তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু জ্ঞানী ও পুণ্যপুত ভিক্ষুসংঘ আগমণ করেন। তারমধ্যে আর্শীবাদক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় সংঘরাজ, ভদন্ত তিলোকানন্দ মহাথের, পাভিসবা, ভদন্ত সুমনা মহাথের, বৌদ্ধ শিশুঘর প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্ঠা পাভিসবা, ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরো, সম্পাদক(প্রাক্তন) পাভিসবা ও অধ্যক্ষ বোয়ালখালী দশবল রাজবিহার, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। উপস্থিত ছিলেন অনেক প্রাজ্ঞ ভিক্ষুসংঘ।

দিনের শুরুতে কর্মসূচীতে সকাল পর্বে সর্বস্তরের হাজারো বৌদ্ধ পুণ্যার্থীদের অংশগ্রহণে বুদ্ধপুজো নিবেদনের সাথে সাথে ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল গ্রহণ। পঞ্চশীল প্রদান করেন পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশ’র মহামান্য সংঘরাজ ও সাদামনের মানুষ উপাধিতে ভূষিত ভদন্ত তিলোকানন্দ মহোথের মহোদয়। দানযজ্ঞের মধ্যে ছিল বুদ্ধমূর্তি দান, সংঘদান, অষ্টপরিক্খার দান ও নানাবিধ দান। পাশাপাশি এই পুণ্যময় দিনে দেশের স্বনামধন্য হামদর্দ ল্যাবরেটরীজ(ওয়াক্ফ) বাংলাদেশ কর্তৃক ফি চিকিৎসা সেবা ও ব্লাড গ্রুফিং করা হয়। তাদের পক্ষ থেকে বিনামূল্য পুণ্যার্থীদের বিভিন্ন ওষুধপত্রাদি বিতরণ করা হয়। এবং সদ্ধর্ম দেশনায় অংশ নেন উদীয়মান ভিক্ষু দীপবংশ। তিনি বৌদ্ধ সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি সকল বিভেদ ভূলে গিয়ে ঐক্যের আহবান জানান।

বিকাল পর্বে, কৌশিক চাকমা ও এলিনা চাকমা সঞ্চালনায় বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের ছাত্রীদের সমবেত উদ্ভোধনী ধর্মিয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের কার্যসূচী শুরু হয়। পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন বিহার কমিটির কোষাধ্যক্ষ মি. সাধনা কীর্তি চাকমা ও স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন কর্নেল(অব.) পরিমল বিকাশ চাকমা। ধর্মালোচনায় অংশ নেন মি. জ্ঞানেন্দ্রিয় চাকমা(গংগো), বারডেম ডাইরেক্টর(প্রাক্তন), গৌতম অরিন্দম (সেলু) বড়ুয়া, ব্যাংকার(অব.) ও বিশিষ্ট শিল্পী, মি. জয়দত্ত বড়ুয়া, সচিব, বৌদ্ধধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট। মি. জ্ঞানেন্দ্রিয় বুদ্ধের আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথ অনুশীলনের মাধ্যমে দু:খমুক্তি সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেন। সেলু বলেন, আজকের অনুষ্ঠান দেখে মনে হচ্ছে নতুন করে বৌদ্ধর্মের নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি প্রজন্মদের উদ্দেশ্য বলেন, আজকের বৌদ্ধ রাষ্ট্র ভূটান পৃথিবীর সুখি দেশ হিসেবে গড়ে উঠার মূল কারণ তারা বুদ্ধের আদর্শে আদর্শিত। সুতরাং বৌদ্ধ হিসেবে আমাদের গর্বের বিষয় বলে মত ব্যক্ত করেন। এদিনে শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ কল্পে ব্রি. জে.(অব.) মং থিন উইন ৫(পাঁচ) লক্ষ টাকার একটি চেক তুলে দেন ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর হাতে।
পুণ্যার্থীদের মঞ্চে কল্পতরু আনয়ণ….ভিক্ষুসংঘের পক্ষ থেকে সদ্ধর্ম ভাষণ করেন উদিয়মান ভিক্ষু, রত্নপ্রিয় থেরো ও উপতিস্স থেরো, প্রভাষক, বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ, ঢাকা। এবং যাবতীয় দানের উৎসর্গের দায়িত্বে ছিলেন ভিক্খু বিপস্সি, শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার(আবাসিক) ও সম্পাদক তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিষয়ক, পাভিসবা। সভাপতি মহোদয়ের সদ্ধর্ম ভাষণের পর ধর্মীয় সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। অনুষ্ঠান শেষে বিশ্বের শান্তি ও মঙ্গল কামনায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।
চীবর’ বলতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র। গাছের শেকড়, গুঁড়ি, ছাল, শুকনো পাতা, ফুল ও ফলের রঙ অনুসারে এর ছয়টি রঙ নির্দিষ্ট। তবে ভিক্ষুসংঘ সাধারণত লাল ফুলের রঙের বস্ত্রই বেশি ব্যবহার করে, যা সাধারণ গৃহীদের পরিধেয় বস্ত্র থেকে পৃথক ও বৈচিত্র্যহীন। মহাবগ্গ গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে- যেদিন চীবর দান করা হবে সেদিনের সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সুতাকাটা, কাপড় বোনা, কাপড় কাটা, সেলাই ও রঙ করা, ধৌত করা ও শুকানো এ কাজগুলি সম্পন্ন পূর্বক উক্ত সময়ের মধ্যেই এ চীবর ভিক্ষুসংঘকে দান করতে হবে। অথবা, বাজারে সেলাইকৃত রেডিমেট চীবরও দান করা যায়। উল্লেখ্য যে, কঠিন চীবর দানের ফল বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে “শতবর্ষের দান কিংবা পৃথিবীর সকল প্রকার দান একত্র করলে তার যে ফল তা একখানি চীবর দানের ফলের ষোলো ভাগের এক ভাগও নয়। সুতরাং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বৌদ্ধদের জন্য চীবর দানের গুরুত্ব অপরিসীম। এ দান জন্মজন্মান্তরে সুফলপ্রদায়ী।
কঠিন চীবর লাভী ভিক্ষুর পাঁচটি আপত্তি দূর হয়-
১। অনামন্তচার (অবগত না করে নিমন্ত্রণে গমন করা)
২। অসমাদানচার (ত্রি-চীবরের যাহা ইচ্ছা রেখে গমন)
৩। গণভোজন (গণভোজনে গমন)
৪। যাবদত্থচীবর (অধিষ্ঠান ব্যতিরেকে চীবর রাখা)
৫। যে বিহারের উদ্দেশ্যে দান হবে, সেই বিহারের সংঘগণ চীবরগুলোর মালিকানা দাবী করতে পারবেন।
বস্তুত, একটি বৌদ্ধ বিহারে বছরে একবার মাত্র এ চীবর দান করা হয়। এদিন বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ গৃহীরা ভিক্ষুসংঘকে চীবর দান তরে থাকেন। ভিক্ষুসংঘও তাদের বিনয়-বিধানের সকল নিয়ম অক্ষুণ্ণ রেখে পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে এ চীবর গ্রহণ ও ব্যবহার করে। কঠিন চীবর দানের বহুধা গুণের কথা স্মরণে রেখে প্রত্যেক বৌদ্ধ জীবনে অন্তত একবার হলেও চীবর দান করার মানসিকতা পোষণ করে
DBC NEWS খবরের লিঙ্ক: কঠিন চীবর দানোৎসব
তথ্য সংগ্রহে: ভিকখু বিপস্সি, সম্পাদক, তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিষয়ক, পাভিসবা